শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ, ১৪৩১
ডাঃ মো: আলী হাসান।।
চাকরি জীবনে সহকর্মীকে বিদায় দেয়া বা তাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়াটা অত্যন্ত বেদনার, কিন্তু দাদাকে ওইভাবে বিদায় দিতে পারাটা আমার জন্য ছিল অত্যন্ত তৃপ্তির। এদিকে অপরজন যে অন্য একটা উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগদান করেছিল তাকেও দাদা যাওয়ার আশেপাশে সময়েই বিদায় দিতে হলো। সে ছিল আমার সাত বছরের সহপাঠী, আমরা দুজন একসাথে সাতটা বছর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ আর হাসপাতালে কাটিয়েছি। ওর কেন্দ্রটা ছিল উপজেলা প্রোপার থেকে বারো কিঃমিঃ দূরে একটা ছোট বাজারে। কেন্দ্রটার নিজস্ব ভবন আছে, টিনের চারচালা ঘর, একদিকে ডিসপেনসারি আর একপাশে রোগী দেখার জায়গা। মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট আর ডাক্তার মিলে এক জায়গাতেই রোগী দেখে, দুজন দুই টেবিলে।
মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্টসহ অন্য সকলেই স্থানীয়, তারা বাড়ি থেকে অফিস করে কিন্তু সরকারি ভাবে কারো থাকার কোন ব্যবস্হা নাই।
আগেই বলেছি এটা একটা বাজারে অবস্থিত এবং বাজারটা নিতান্তই ছোট, হাতে গোনা কয়েকটা মুদি দোকান আর একটা ঔষধের ফার্মেসী। পাশে একটা হাইস্কুল আর একটা প্রাইমারি স্কুল আছে, স্কুল ছুটির পর যে যার বাড়ির দিকে চলে যায়, বলতে গেলে বিকাল বেলা ঐ কয়েকজন মুদি দোকানী আর ফার্মেসীর মালিক ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়না একটু কথা বলার জন্য। উপজেলা প্রোপার থেকে বারো কিঃমিঃ দূরত্ব যদি এই আমলে চিন্তা করি, এটা কিছুই না, পনেরো মিনিটের ব্যাপার। কিন্তু সেই সময়ে এটা ছিল অকল্পনীয়।
দাদা যে কেন্দ্রে ছিলেন সেটা উপজেলা থেকে কত কিঃমিঃ দূরে তা বলতে পারবো না, তবে ওখানে যাবার উপায় ছিল দুপুর দুটোয় ইঞ্জিনচালিত একটা নৌকা, সময় লাগতো চার ঘন্টা আর পরেরদিন সকাল ছটায় ওই নৌকায় ফিরে আসে সকাল দশটায়। যদি কেউ এই সময়টা মিস করে তাহলে তাকে পরের দিনের চিন্তা করতে হতো।
এই কেন্দ্রের চিত্রটা ভিন্ন, এটার যোগাযোগ ব্যবস্থা এক মাত্র পায়ে হাঁটা। বারো কিঃমিঃ রাস্তা আমাদের ওই বয়সে তেমন কোন ব্যাপার না, কিন্তু অসুবিধা হলো এইটুকু রাস্তা যেতে আটটা খাল পার হতে হবে, যেগুলোর উপর এক বাঁশের সাঁকো অথবা বাঁশের পাটাতন করা। সারা বছর এগুলোর দুএকটা অকেজো থাকবেই। এগুলো পার হতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে এবং এ রকম দুর্ঘটনার রোগী হরহামেশাই পেতাম। এরকম রাস্তা দিয়ে আমাদের মত আনকোরা মানুষের জন্য চলাচল নিতান্তই একটা ভীতিকর ব্যাপার। এ কারণে বারো কিঃমিঃ রাস্তা যেতে আসতে সময় লাগতো কমপক্ষে ছয় ঘন্টা।
আমার বন্ধুটি ওখানে থেকেই চাকরি করা শুরু করলো। কোন বাড়ি নাই ভাড়া করে থাকার, কোন হোটেল নাই খাবার জন্য। রাতে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভিতরে রোগী দেখার টেবিলে ঘুমায়, মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট তার বাড়ি থেকে দুবেলার খাবার দেয়, খালে গোসল করে আর পাশে একটা পাকা মসজিদ ছিল সেখানে বাথরুম সারে।
সপ্তাহ খানেক যাবার পর চিন্তা করলাম এ ভাবে একজন অফিসার থাকতে পারেনা। মান মর্যাদা পরের কথা, নিরাপত্তা একটা বিশেষ বিষয়। ওকে বললাম তোমার ওখানে থাকার দরকার নাই, তুমি আমার সাথে এখানে থাকো আর একটু কষ্ট করো, হেঁটে যাওয়া আসা করো, কারণ সবার উপরে নিজের জীবন আগে। আর এর সাথে সাথে চেষ্টা করো তোমাদের ওদিকে যাবার জন্য। বেচারা তাই করলো, তবে তিন ঘন্টা হেঁটে গিয়ে কি সেবা দিতে পারতো অনুমান করি। ছাত্রাবস্থায় তো রিকশা ছাড়া এক কদমও হাঁটতাম না। যাহোক আটমাসের মাথায় সে চলে গেল কারণ ওরটা ছিল একই ডিভিশনে। চলবে…
লেখক: (শিশু বিভাগ) এর সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল।